ইউরোপীয়দের আগমন

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব | | NCTB BOOK

সপ্তম শতক থেকে এ অঞ্চলের সঙ্গে আরব বণিকদের ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল একচেটিয়া । তারা বাণিজ্য করত মূলত সমুদ্রপথে। ১৪৫৩ সালে কন্সস্টান্টিনোপোল উসমানীয় তুর্কিরা দখল করে নেয় । ফলে উপমহাদেশের সাথে জলপথে ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় । সুতরাং প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ব্যবসায় - বাণিজ্যের জন্য ভিন্ন জলপথ আবিষ্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই ইউরোপীয় শক্তিগুলো সমুদ্রপথে উপমহাদেশে আসার অভিযান শুরু করে ।

 

পর্তুগিজ:

পর্তুগিজদের মধ্যে যে দুঃসাহসী নাবিক প্রথম সমুদ্রপথে এদেশে আসেন, তাঁর নাম ভাস্কো-ডা-গামা । তিনি ১৪৯৮ সালের ২৭শে মে ভারতের পশ্চিম-উপকূলের কালিকট বন্দরে এসে উপস্থিত হন। উপমহাদেশে তাঁর এ আগমন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করে । পর্তুগিজরা ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশে এদেশে আসে কিন্তু ক্রমে তারা সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে ঝুঁকে পড়ে । স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ইউরোপীয় বণিকরা উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলের কালিকট, চৌল, বোম্বাই, সালসেটি, বেসিন, কোচিন, গোয়া, দমন, দিউ প্রভৃতি বন্দরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।

১৫৩৮ সালে তারা চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে বাণিজ্যঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি লাভ করে। ১৫৭৯ সালে হুগলী নামক স্থানে তারা উপনিবেশ গড়ে তোলে। এরপর তারা উড়িষ্যা এবং বাংলার কিছু অঞ্চলে বসতি সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয় । বাংলাসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা থাকলেও পর্তুগিজদের বিভিন্ন অপকর্ম ও দস্যুতার কারণে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান তাদের চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপের ঘাঁটি দখল করে বাংলা থেকে বিতাড়ন করেন। তাছাড়া পর্তুগিজরা এদেশে আগত অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হয় । ফলে এরা এ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ।

 

ওলন্দাজ বা ডাচ:

হল্যান্ডের অধিবাসী ওলন্দাজ বা ডাচরা 'ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' গঠন করে বাণিজ্যিক উদ্দেশে ১৬০২ সালে এই উপমহাদেশে আসে । ভারতবর্ষে তারা কোম্পানির সনদ অনুযায়ী কালিকট, নাগাপট্টম, বাংলার চুঁচুড়া ও বাঁকুড়ায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাছাড়া বালাসোর, কাশিমবাজার এবং বরানগরেও তারা কুঠি স্থাপন করে । ওলন্দাজ ও অপর ইউরোপীয় শক্তি ইংরেজদের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ে বিরোধ শুরু হয় এবং একই সঙ্গে বাংলার শাসকদের সঙ্গে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ১৭৫৯ সালে সংঘটিত বিদারার যুদ্ধে তারা ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ফলে ১৮০৫ সালে তারা সকল বাণিজ্য কেন্দ্র গুটিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় । প্রথমে পর্তুগিজ পরে ওলন্দাজ শক্তির পতন, ভারতে ইংরেজ শক্তির উত্থানের পথ সুগম করে।

 

দিনেমার:

দিনেমার বা ডেনমার্কের অধিবাসী একদল বণিক বাণিজ্য করার উদ্দেশে ‘ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' গঠন করেন । ১৬২০ সালে তারা দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর জেলায় ত্রিবাঙ্কুর এবং ১৬৭৬ সালে বাংলার শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। কিন্তু এদেশে তারা লাভজনক ব্যবসায় করতে ব্যর্থ হয় । ১৮৪৫ সালে ইংরেজদের কাছে বাণিজ্য কুঠি বিক্রি করে কোনো রকম বাণিজ্যিক সফলতা ছাড়াই দিনেমাররা এদেশ ত্যাগ করে ।

 

ইংরেজ:

সমুদ্রপথে ইউরোপীয় বণিকদের সাফল্য, প্রাচ্যের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, ইংরেজ বণিকদেরকেও এ অঞ্চলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উৎসাহিত করে । এই উদ্দেশে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বণিক সংঘ গড়ে তোলে । বণিক সংঘটি ১৬০০ সালে রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি প্রাচ্যে একচেটিয়া বাণিজ্য করার সনদপত্র লাভ করে । এই সনদপত্র নিয়ে কোম্পানির প্রতিনিধি বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের আশায় আকবরের দরবারে হাজির হন । এরপর ক্যাপ্টেন হকিন্স ১৬০৮ সালে রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে ১৬১২ সালে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে ১৬১৫ সালে প্রথম জেমসের দূত হয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন স্যার টমাস রো । সম্রাটের কাছ থেকে তিনি ইংরেজদের জন্য বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেন । ১৬১৯ সালে তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন । ইতোমধ্যে কোম্পানি সুরাট, আগ্রা, আহমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তাদের ভিত্তি মজবুত করে।

কোম্পানি দ্বিতীয় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে মসলিপট্টমে। এরপর বাংলার বালাসোরে আরেকটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাদের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে এরা করমণ্ডল (মাদ্রাজ শহর) উপকূলে একটি দুর্গ নির্মাণ করতে সক্ষম হয় । বাংলার সুবাদার শাহ সুজার অনুমোদন লাভ করে তারা ১৬৫৮ সালে হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে । এভাবে কোম্পানি কাশিমবাজার, ঢাকা, মালদহেও বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে ।
১৬৬৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথারিনের সঙ্গে বিয়ের যৌতুক হিসেবে লাভ করেন বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) শহর । অর্থাভাবে চার্লস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে শহরটি বিক্রি করে দেন। পরবর্তীকালে এই বোম্বাই শহরই কোম্পানির প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয় ।

জব চার্নক নামে আরেকজন ইংরেজ ১৬৯০ সালে ১২০০ টাকার বিনিময়ে কোলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন । ভাগীরথী নদীর তীরের এই তিনটি গ্রামকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে কোলকাতা নগরীর জন্ম হয়। এখানেই কোম্পানি ১৭০০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নাম অনুসারে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে। ধীরে ধীরে এটি ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ বিস্তারের শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হয় ।

ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায় যখন দিল্লির সম্রাট ফাররুখশিয়ার তাদের বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করেন। একই সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকারও কোম্পানি লাভ করে । সম্রাটের এই ফরমানকে ইংরেজ ঐতিহাসিক ওরমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মহা সনদ বা ম্যাগনা কার্টা বলে উল্লেখ করেন । এই অধিকার লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপ্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসর হতে থাকে ।

 

ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি:

উপমহাদেশে সর্বশেষে আগত ইউরোপীয় বণিক কোম্পানি হচ্ছে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । ১৬৬৪ সালে এই বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠিত হয়। ১৬৬৮ সালে কোম্পানি সর্বপ্রথম সুরাট এবং পরের বছর মুসলিপট্টমে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৬৭৩ সালে পন্ডিচেরিতে ফরাসি উপনিবেশ গড়ে ওঠে ১৬৭৪ সালের পর থেকে তারা তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাংলায় সম্প্রসারিত করে । কোম্পানি বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানের কাছ থেকে গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত চন্দননগর নামক স্থানটি কিনে নেয় । ১৬৯০ থেকে ১৬৯২ সালের মধ্যে চন্দননগর একটি শক্তিশালী সুরক্ষিত ফরাসি বাণিজ্য কুঠিতে পরিণত হয় । ১৬৯৬ সালে কোম্পানি এখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ স্থাপন করতে সক্ষম হয় । নির্দিষ্ট হারে শুল্ক প্রদানের শর্তে ১৬৯৩ সালে ফরাসিরা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে । পরবর্তীকালে তারা কাশিমবাজার বালাসোরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।

ইংরেজ বণিকরা যখন ব্যবসায়-বাণিজ্যে দৃঢ় অবস্থানে, তখন ফরাসিরা এদেশে আসে। এ অবস্থায় ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির মতো ফরাসিরাও এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকে । ফলে দুই ইউরোপীয় শক্তি— ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় । ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, কুটকৌশল, উন্নত রণকৌশলের কাছে ফরাসিরা পরাজিত হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিরা বাংলার নবাবকে সমর্থন দেয়। কিন্তু এই যুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্য ফরাসিদের আরও বিপর্যস্ত করে ফেলে। ফলে বাংলার ফরাসি বাণিজ্য কুঠিগুলো ইংরেজদের দখলে চলে যায়। দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকের যুদ্ধসমূহে ফরাসি কোম্পানি পরাজিত হলে তারা এদেশ ত্যাগ করে। ফলে ইংরেজরা ভারতবর্ষে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়।

Content added By
Promotion